জুলাই ২৯, ২০১৮
নির্বাচন স্থানীয় কিন্তু মহড়া জাতীয় নির্বাচনের
মাসুদা ভাট্টি দেশের তিন প্রধান সিটি করপোরেশন নির্বাচন ৩০ জুলাই। এর আগে খুলনা ও গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং সরকারি দলের নির্বাচনি কৌশলকে মোটা দাগে বিতর্কিত করায় সফলতা অর্জন করতে পেরেছে বিএনপি এবং দেশের সুশীল সমাজের একাংশ, যারা মূলত বিখ্যাতই হয়েছেন দেশের চলমান রাজনীতির সমালোচনা করে। দেশের রাজনীতির মতো গণমাধ্যমও বিভক্ত এবং এই বিভক্তি লক্ষ করা গেছে বিগত ও চলমান সিটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করেও। বিশেষ করে একটি পক্ষ বলতে চেয়েছে খুলনা ও গাজীপুরে অনিয়ম একেবারে যে হয়নি তা নয়, কিন্তু বাংলাদেশের কোনও নির্বাচনই এরকম অনিয়মের বাইরে ছিল না। এটা প্রাতিষ্ঠানিক ত্রুটি নয়, ব্যক্তির অবস্থানের ত্রুটি। নির্বাচন কমিশন ক্রমশ এসব ত্রুটি কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবে। অপরদিকে যারা এই নির্বাচনকে কারচুপির ‘খুলনা মডেল’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছেন তারা সরাসরি নির্বাচন কমিশনকে বিতর্কিত করতে চাইছেন। বিশেষ করে পুলিশ ও প্রশাসনের ভূমিকাকে তারা কেবল বিতর্কিতই নয়, বলতে চাইছেন ‘ন্যক্কারজনক’। তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিদেশি দূতাবাস থেকে যখন বক্তব্য দেওয়া হয়েছে, তখন তারা ধরেই নিয়েছেন যে তারা যে প্রচার চালিয়েছেন নির্বাচন বিষয়ে, তাতে তারা সম্পূর্ণ সফলতা অর্জন করেছেন। কিন্তু লক্ষণীয় যে, সেই বিদেশি দূতাবাসের পক্ষ থেকেই যখন চলমান সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে দেখা করে, এই কমিশনের অধীনেই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব বলে বক্তব্য দেওয়া হয় তখন আসলে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে খুলনা ও গাজীপুরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে যে সব ভোটার ভোট দিয়েছেন তাদের প্রতি এই বিদেশি দূতাবাসের পক্ষ থেকে আস্থা স্থাপন করা হয়েছে এবং বিগত দুটি নির্বাচনের অনিয়মকে আসলে ‘সিস্টেম লস’ হিসেবেই অগ্রাহ্য করে ‘মোটামুটি সুষ্ঠু’ নির্বাচনের সার্টিফিকেটই দেওয়া হয়েছে। প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের নির্বাচনের জন্য বিদেশি সার্টিফিকেট কি আসলে প্রয়োজন কিনা? নাকি নিজেদের নির্বাচনে নিজেদেরই স্বচ্ছতা নির্ধারণ এবং সুষ্ঠুতা নিরূপণের দায়িত্ব পালন করতে হবে? এসব প্রশ্ন মাথায় রেখেই চলমান তিন সিটি নির্বাচনের প্রচারণা দেখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও ব্যক্তিগতভাবে রাজশাহী ও বরিশালে গিয়ে নির্বাচনি-অবস্থা সরেজমিন দেখা সম্ভব হয়েছে। সিলেটে যাওয়া সম্ভব না হলেও একাধিক ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান এবং প্রার্থীর সঙ্গে আলোচনা করার সুযোগ হয়েছে। এসবেরই আলোকে আজকের বিশ্লেষণ। রাজশাহী: ভোটারদের চিন্তাভাবনা সম্পূর্ণ স্বচ্ছ রাজশাহীতে গিয়ে একটি বিষয় বারবারই মনে হয়েছে যে এবার রাজশাহীবাসী আসলে তাদের শহরের জন্য ‘কিছু’ চাইছেন, যিনি তা দিতে পারবেন তিনিই হবেন তাদের মেয়র। বিগত দিনে শহরটির উন্নয়ন কতটা কী হয়েছে তা নিয়ে প্রতিটি নাগরিক ওয়াকিবহাল। যা হওয়ার কথা ছিল তা কেন হয়নি সে বিষয়েও তারা জ্ঞাত। দল ক্ষমতায় না থাকলে যে স্থানীয় সরকারের উন্নয়ন সম্ভব নয়, তা সে যত শক্তিশালী প্রার্থীই হোন না কেন, সেটি রাজশাহীর বেশিরভাগ নাগরিকই ক্ষোভের সঙ্গে বললেন। এমনিতে এই শহরের ভোটাদের মাঝে বিএনপি’র পক্ষে রয়েছে বিশাল একটি ভোটব্যাংক। যারা মূলত দেশভাগের পর ভারত থেকে এসে পূর্ব পাকিস্তানে থিতু হয়েছিলেন। তাদের কাছে আওয়ামী লীগ পাকিস্তান ভাঙার জন্য দায়ী এবং দলটির ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির পক্ষে তারা নন। ফলে তারা নিজেদের বিশ্বাসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বোধ করেন বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতিকে। কিন্তু ২০১৩ সালে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীকে ভোট দিয়ে তারা শহরটির জন্য তেমন কিছুই আনতে পারেননি, কারণ কেন্দ্রে রয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। ফলে তারা মনে করেন যে সরকারি দলকে ভোট দিলেই এবার শহরের জন্য কিছু না কিছু আসবে, পর পর দু’মেয়াদে যদি শহরের কোনও উন্নয়ন না হয় তাহলে আখেরে ক্ষতি রাজশাহীবাসীরই হবে। অপরদিকে বিএনপি’র দলীয় কোন্দল শহরে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। প্রধান নেতাদের মাঝে মুখ দেখাদেখি বন্ধ, নির্বাচন উপলক্ষে কেন্দ্রীয় নেতারা শহরের নেতৃত্বকে মিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেও তাতে সফলতা কতটুকু কী এসেছে তা প্রশ্নসাপেক্ষ। সবচেয়ে বড় কথা বিএনপি’র রাজনৈতিক সঙ্গী জামায়াতও এবারের ভোটে একটু দোনোমনো অবস্থায় রয়েছে। অপরদিকে সরকারি দলের মধ্যে অন্তত মেয়র নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কোনও ধরনের কোন্দল তো নেই, বরং প্রার্থীকে জিতিয়ে আনার জন্য আশপাশের জেলা থেকেও নেতারা রাজশাহীতে এসে প্রচারণা চালাচ্ছেন। রাজশাহী শহরের ভোটার হিসেবে আশপাশে বিশেষ করে নওগাঁ, নাটোর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোটার রয়েছেন মোট ভোটারের প্রায় অর্ধেক। ফলে তাদের ভোট পেতে মরিয়া হয়ে কাজ করছেন প্রার্থীরা। প্রশাসনের বিরুদ্ধে সরকারবিরোধী প্রার্থীর অভিযোগ রয়েছে কিন্তু সেসব কবে কোথায় ছিল না এদেশের নির্বাচনে? এই প্রশ্ন নিয়ে প্রার্থীও মাঝে মাঝে কেন্দ্রের অতিরঞ্জনকে নির্বাচনের মাঠের পক্ষে সুবিধাজনক বলে মন্তব্য করেছেন নিকটজনদের কাছে। সরকার প্রচারণা করতে বাধা দিচ্ছে এই অভিযোগ থাকলেও রাজশাহী শহরের পর্যটন হোটেলকে কেন্দ্র করে সেখান থেকেই প্রচারণা চালাচ্ছে বিএনপি-নেতৃবৃন্দ। সরকারি দলের একজন সমর্থক দাবি করছেন, ২০১৩ সালের মতো এবারও বিএনপি’র পক্ষ থেকে সরকারের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। বিশেষ করে নারী ভোটারদের দু-একজন স্বীকারও করেছেন যে তাদের একটি ভিডিওচিত্র দেখিয়ে বলা হয়েছে, সরকার জঙ্গি দমনের নামে ধর্মপ্রাণ তরুণদের গুলি করে হত্যা করছে। ঠিক এই অবস্থার মাঝেই, সাধারণ একজন ভোটার, যিনি রাজশাহী শহরের জিরো পয়েন্টে ফুল বিক্রি করেন, তিনি বলেছেন সবচেয়ে সরল সত্য কথাটি, তিনি বললেন, ‘বিএনপির কী– জিতলে বলবে সরকারের অপশাসনের বিরুদ্ধে জনগণের বিজয় আর হারলে বলবে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। নির্বাচন কমিশন বাতিল করো এবং সরকারের পদত্যাগ চাই। তাদের তো সব দিকেই লাভ’। রাজশাহী শহরে বিএনপির প্রচার-প্রচারণা এবং কার্যক্রম দেখে এটাই মনে হয়েছে যে দলটি আসলে প্রচারণার ক্ষেত্রে ঢিলেঢালা গতিকেই বেছে নিয়েছে। বরিশাল: ঘাঁটি বিএনপির কিন্তু নৌকার নবীন মাঝি এই সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে ঘিরে সবচেয়ে কম আলোচনা ঢাকার গণমাধ্যমে লক্ষ করা গেছে। সরেজমিন গিয়েও দেখা গেলো শহরটিতে নির্বাচনি উত্তেজনা একটু কমই। কারণ কী জানতে চাওয়া হলে ভোটারদের বেশিরভাগই বললেন, এই শহরে বিএনপি-প্রার্থী তিনবার এমপি এবং একবার মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করে নিজের অবস্থানকে সুসংহত করেছেন, তার পক্ষে নতুন করে প্রচারণার কিছুই নেই। তিনি তার সমর্থকদের কাউকে একথাও বলেছেন যে জিতলে এমনিতেই জিতবো, আর হারলে সরকার আমাকে হারাবে। তার পক্ষ থেকে প্রচারণায় ভোটারদের কেন্দ্রে না যাওয়ার নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে বলে তরুণ ভোটাররা অভিযোগ করেছেন। কারণ হিসেবে ভোটের দিন গণ্ডগোল হতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অপরদিকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বয়সে তরুণ এবং এবারই প্রথম নির্বাচন করছেন। সরকারি দলের স্বাভাবিক সুবিধা তিনি পাচ্ছেন বটে সমর্থকদের কাছ থেকে কিন্তু তার নিজস্ব ক্যারিশমার কোনও প্রমাণ দিতে পারছেন না। তবে গত দু’বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি এখানে ভোটারদের মাঝে কাজ করছেন বলে দাবি করেছেন। ফলে উভয় দলই যেন নির্বাচনি মাঠে ঢিমে-তেতালা চালে চলছেন। কিন্তু বরিশালে নির্বাচনি প্রচারণায় উজ্জ্বলতার দ্যুতি ছড়াচ্ছেন বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের প্রার্থী মনীষা চক্রবর্ত্তী। পেশায় চিকিৎসক এই প্রার্থী শহরবাসীর পক্ষে গত বছরখানেক রাস্তার আন্দোলনে ছিলেন এবং তারাই মূলত তার পক্ষে কাজ করে চলেছেন। ভোটের সময় নাকি ‘নগরের নাড়ি’ সম্পর্কে সবচেয়ে স্পষ্টভাবে জানা যায়। বরিশালে চরমোনাই পীরের ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের প্রার্থী দিনমান সকল এলাকায় একশ দেড়শ মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের দিয়ে মিছিল করাচ্ছেন এবং আল্লাহ ও নবীর পক্ষে ভোট প্রার্থনা করছেন। ভোটে ধর্মের এই ব্যবহার ভবিষ্যতে অন্য ধর্মাশ্রয়ী দলও যখন করতে শুরু করবে তখন বিভেদ অনিবার্য হয়ে উঠবে যে প্রকৃতপক্ষে কোন প্রার্থীকে ভোট দিলে আসলে আল্লাহর পক্ষে ভোট দেওয়া হবে? সিলেট শহরে না গেলেও দীর্ঘদিন লন্ডনে বসবাস করার ফলে সিলেটবাসীর সম্পর্কে স্পষ্ট একটি ধারণা রয়েছে। একাধিক পরিচিত ব্যক্তি সেখানে প্রতিটি দলের প্রার্থীদের পক্ষে প্রচারণা চালাতে লন্ডন থেকে এসেছেন এবং তাদের সঙ্গে কথাবার্তা থেকে বোঝা যাচ্ছে যে এই শহরেই প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্রে সরকার ও বিরোধী পক্ষ মোটামুটি সমানে সমানে চালিয়ে যাচ্ছেন প্রচারণা। তবে বিএনপি শুরুতেই হোঁচট খেয়েছে জামায়াতের প্রার্থী আলাদা হওয়ায়। কিন্তু সব মিলিয়ে এখানে কেউই মাঠ ছেড়ে দেওয়ার পক্ষে নন, সেটা বোঝা যাচ্ছে। যেমনটি বরিশাল বা রাজশাহীতে হচ্ছে, জিতলে ভালো না জিতলেও কোনও ক্ষতি নেই– এমন মনোভাব অন্তত সিলেটে নেই। তবে সিটি নির্বাচনগুলোকে কেন্দ্র করে এই যে খুলনা বা গাজীপুর মডেল বলে যেসব প্রচারণা চালানো হচ্ছে চলমান তিনি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সেরকম কোনও লক্ষণ আগের প্রচারণাকারীরাও তুলতে পারছেন না, ভরসা সেখানেই। সিটি নির্বাচন হচ্ছে, কিন্তু জাতীয় নির্বাচনের মহড়া চলছে– তিন শহরের বাসিন্দারাই একথা স্পষ্ট করেছেন তাদের বক্তব্যে। নির্বাচনি ফলাফল যাই-ই হোক না কেন, এই সিটি নির্বাচনসমূহ রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য স্পষ্ট বার্তাই দেবে। প্রশ্ন হলো, এই বার্তাসমূহ কে কীভাবে নেবেন, সেটাই হবে দেখার বিষয়। লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক আমাদের অর্থনীতি masuda.bhatti@gmail.com
<বাংলা ট্রিবিউন থেকে> 8,555,084 total views, 5,690 views today |
|
|
|